বিসমিল্লাহির রহমানির
রহিম
জামা‘আত ও ইমামতি
(৫) কাতারের মধ্যে পরস্পরের মাঝে ফাঁক রেখে দাঁড়ানো :
জামা‘আতের সাথে সালাত আদায় করার সময় কাতারের মাঝে পরস্পরের মধ্যে ফাঁক রাখা
সুন্নাতের বরখেলাফ।
উক্ত মর্মে কোন হাদীছ বর্ণিত হয়নি। পরস্পরের পায়ের মাঝে ‘চার আঙ্গুল’ পরিমাণ ফাঁক
রাখতে হবে এবং পায়ে পা মিলালে অন্যকে অপমান করা হয় মর্মে সমাজে যে কথা
প্রচলিত আছে, তা এক প্রকার জাহেলিয়াত।
এটি সুন্নাতকে অবজ্ঞা করার অপকৌশল এবং চূড়ান্ত মিথ্যাচার। কারণ যারা পৃথিবীর
সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, তারা যদি পরস্পরে দাঁড়িয়ে পায়ে পা মিলিয়ে সালাত পড়তে পারেন, তাহলে
আমাদের সম্মানের হানি হবে কেন? আমাদেরকেও তাঁদের পদাংক অনুসরণ করতে হবে।
কারণ পায়ে পা, টাখনুর সাথে টাখনু ও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সালাতে দাঁড়াতে হবে মর্মে রাসূল
(সা.) বহু হাদীছে নির্দেশ করেছেন।
আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কাতারের মাঝে
ফাঁক বন্ধ করে দাঁড়াবে, এর বিনিময়ে আললাহ তার একটি মর্যাদা বৃদ্ধি করে দিবেন এবং
তার
জন্য জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ করবেন।
সুধী পাঠক! মুরববীরা বলে থাকেন, পায়ের সাথে পা মিলালে সম্মান নষ্ট হয়। আর রাসূল
(সা.) বলছেন, আল্লাহ সম্মান বৃদ্ধি করে দেন। আমি তাহলে কার কথা গ্রহণ করব?
অতএব সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরুন। রাসূল (সা.)-এর শাফা‘আত লাভে ধন্য হৌন!
আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ এবং ফেরেশতগণ তাদের প্রতি
রহমত বর্ষণ করেন, যারা কাতারবন্দী হয়ে সালাত আদায় করেন। আর যে ব্যক্তি
কাতারের ফাঁক বন্ধ করে দাঁড়ায়, আল্লাহ তা‘আলা এর বিনিময়ে তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে
দেন।
ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা কাতার সোজা করবে,
বাহুসমূহকে বরাবর রাখবে, ফাঁক সমূহ বন্ধ করবে এবং তোমাদের ভাইদের হাতের সাথে
নম্রতা বজায় রেখে মিলিয়ে দিবে; মধ্যখানে শয়তানের জন্য ফাঁক রাখবে না।
যে ব্যক্তি কাতারের মাঝে মিলিয়ে দাঁড়ায়, আল্লাহ তাকে তাঁর নিকটবর্তী করে নেন। আর
যে ব্যক্তি কাতারের মাঝে পৃথক করে দেয় আল্লাহও তাকে পৃথক করে
দেন।
নু‘মান ইবনু বাশীর (রাঃ) বলেন, রাসূল (সা.) মুছল্লীদের দিকে মুখ করতেন অতঃপর
বলতেন, তোমরা কাতার সোজ কর।
এভাবে তিনি তিনবার বলতেন। আমি আল্লাহর কসম করে বলছি, তোমরা তোমাদের
কাতার সোজা করবে অথবা আল্লাহ তোমাদের অন্তরের মাঝে ফাটল সৃষ্টি করে দিবেন।
রাবী বলেন, অতঃপর আমি দেখতাম, মুছল্লী তার সাথী ভাইয়ের কাঁধে কাঁধ, হাঁটুর পার্শ্বের
সাথে হাঁটুর পার্শ্ব এবং টাখনুর সাথে টাখনু ভিড়িয়ে দিত।
বারা ইবনু আযেব (রাঃ) বলেন, রাসূল (সা.) কাতারের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত
পর্যন্ত বরাবর করতেন।
তিনি আমাদের বুক ও কাঁধ স্পর্শ করতেন এবং বলতেন, তোমরা পৃথক পৃথক হয়ে
দাঁড়াইয়ো না। অন্যথা তোমাদের অন্তরসমূহ পৃথক হয়ে যাবে।
তিনি আরো বলতেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ এবং ফেরেশতাগণ প্রথম কাতারের মুছল্লীদের উপর
রহমত নাযিল করেন।
আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের কাতার সোজা
কর। নিশ্চয় আমি তোমাদেরকে আমার পিছন থেকে দেখতে পাই।
আনাস (রাঃ) বলেন, আমাদের একজন অপরজনের কাঁধে কাঁধ ও পায়ে পায়ে মিলিয়ে
দাঁড়াতেন। ইমাম বুখারী (রহঃ) উক্ত হাদীছ বর্ণনা করার পূর্বে নিম্নোক্ত অনুচ্ছেদ রচনা
করেছেন,
‘সালাতে কাতারের মধ্যে কাঁধে কাঁধ ও পায়ে পা মিলানো অনুচ্ছেদ’। নু‘মান ইবনু বাশীর
(রাঃ) বলেন, আমি মুছল্লীকে দেখতাম, সে তার টাখনুকে তার পার্শ্বের ভাইয়ের টাখনুর
সাথে মিলিয়ে দিত। শায়খ আলবানী (রহঃ) দুঃখ প্রকাশ করে বলেন,
‘দুঃখজনক বিষয় হল, কাতার সোজা করার সুন্নাতকে মুসলিমরা অবজ্ঞা করে চলেছে; বরং
কিছু সংখ্যক মানুষ ব্যতীত অন্যরা সবাই এই সুন্নাতকে নষ্ট করেছে।
নিশ্চয় আমি সেই দলগুলোর মধ্যে ‘আহলেহাদীছ’ ব্যতীত অন্য কারো মধ্যে উক্ত সুন্নাত
দেখিনি। আমি মক্কায় (১৩৬৮ হিঃ) তাদেরকে দেখেছি, তারা রাসূল (ছাঃ)-এর অন্যান্য
সুন্নাতকে যেমন আঁকড়ে ধরে আছে, তেমনি এই সুন্নাতকেও আঁকড়ে ধরার প্রতি অতীব
অনুরাগী।
চার মাযহাবের অনুসারীদের বিপরীতে তারাই একে আঁকড়ে ধরে আছে। হাম্বলীদেরকেও
আমি এদের মধ্য থেকে পৃথক করি না। কারণ তাদের মধ্য হতে এটা সম্পূর্ণই উঠে গেছে।
বরং তারা এই সুন্নাতকে পরিত্যাগ করা এবং তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার পথ অবলম্বন
করছে।
অধিকাংশ মাযহাব এই সুন্নাহর বিরুদ্ধে দলীল পেশ করছে যে, কাতারে দাঁড়ানোর সময়
উভয় মুছল্লীর পায়ের মাঝে ‘চার আঙ্গুল’ ফাঁক রাখতে হবে।
যদি এর অতিরিক্ত ফাঁক হয় তবে অপসন্দনীয়। যেমন ‘আল-ফিক্বহু আলাল মাযাহিবিল
আরবা‘আহ’ (১/২০৭ পৃঃ) গ্রন্থের মধ্যে এ বিষয়ে আলোচনা এসেছে।
অথচ সুন্নাহর মধ্যে উক্ত পরিমাণের কোন ভিত্তি নেই; স্রেফ কল্পনা মাত্র’।
আবু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) সালাতে আমাদের বাহুগুলোকে পরস্পরের
সাথে মিলিয়ে দিতেন এবং বলতেন, সোজা হয়ে দাঁড়াও; পৃথক পৃথক হয়ে দাঁড়াইয়ো না।
অন্যথা তোমাদের অন্তরসমূহ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তোমাদের মধ্যে যারা বয়স্ক ও বুদ্ধিমান
তারাই যেন আমার নিকটে থাকে।
অতঃপর যারা বয়স ও বুদ্ধিতে তাদের ন্যায়, তারা যেন থাকে। অতঃপর যারা উভয় দিক
থেকে নিকটবর্তী তারা যেন থাকে। আবু মাসঊদ বলেন, তোমরা আজ অত্যধিক বিচ্ছিন্ন
হয়ে পড়েছ।
আনাস (রাঃ) বলেন, একদা সালাতের ইক্বামত দেওয়া হল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.)
আমাদের দিকে মুখ ফিরালেন এবং বললেন, তোমরা কাতার সোজা কর এবং পরস্পরে মিলে
দাঁড়াও। নিশ্চয়
আমি তোমাদেরকে আমার পিছন থেকেও দেখতে পাই।
আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা কাতার সমূহে পরস্পরে মিলে
দাঁড়াবে এবং পরস্পরকে কাছে টেনে নিবে। আর তোমাদের ঘাড় সমূহকে সমপর্যায়ে সোজা
রাখবে।
আমি ঐ সত্তার কসম করে বলছি, যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, নিশ্চয়ই আমি শয়তানকে
দেখি সে কাতারের ফাঁক সমূহে প্রবেশ করে, কাল ভেড়ার বাচ্চা ন্যায়।
সুধী পাঠক! কাতারে দাঁড়ানোর সময় পায়ের সাথে পা, টাখনুর সাথে টাখনু এবং কাঁধের
সাথে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ানো ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই।
উক্ত হাদীছ সমূহ জানার পরও কেউ যদি এই সুন্নাতকে প্রত্যাখ্যান করে, তবে সে সরাসরি
রাসূল (সা.)-এর আদেশ লংঘন করবে।
হাদীছে সীসা ঢালা প্রাচীরের মত দাঁড়াতে বলা হয়েছে, যেমন একটি ইট আরেকটি ইটের
উপর রেখে প্রাচীর নির্মাণ করা হয়।
সুতরাং পরস্পরের পায়ের মাঝে কোন ফাঁক থাকবে না। উল্লেখ্য, অনেক মসজিদে শুধু
কনিষ্ঠা আঙ্গুলের সাথে মিলানো হয়। উক্ত মর্মেও কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না।
৬৩৪. আবুদাঊদ হা/৬৩৭, ১/৯৩ পৃঃ, সনদ ছহীহ; আওনুল মা‘বূদ ২/৩৪০।
৬৩৫. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, বুখারী হা/৮০৯, ১/১১২ পৃঃ, (ইফাবা হা/৭৭২, ২/১৩৬ পৃঃ);
মুসলিম হা/১১২৩; মিশকাত হা/৮৮৭; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৮২৭, ২/২৯৭ পৃঃ।
৬৩৬. ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল আওসাত্ব হা/৫৭৯৫; মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ হা/
৩৮২৪; সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৮৯২।
৬৩৭. ইবনু মাজাহ হা/৯৯৫; মুসনাদে আহমাদ হা/২৪৬৩১; সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহাহ
হা/২৫৩২।
৬৩৮. ছহীহ আবুদাঊদ হা/৬৬৬, ১ম খন্ড, পৃঃ ৯৭, সনদ ছহীহ; মিশকাত হা/১১০২;
বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১০৩৪, ৩/৬১ পৃঃ।
৬৩৯. আবুদাঊদ হা/৬৬২, ১ম খন্ড, পৃঃ ৯৭, সনদ ছহীহ।
৬৪০. আবুদাঊদ হা/৬৬৪, ১ম খন্ড, পৃঃ ৯৭, সনদ ছহীহ।
৬৪১. ছহীহ বুখারী হা/৭২৫, ১ম খন্ড, পৃঃ ১০০, (ইফাবা হা/৬৮৯, ২/৯৫ পৃঃ)।
৬৪২. ছহীহ বুখারী ‘আযান’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৪৭, ১ম খন্ড, পৃঃ ১০০, (ইফাবা
অনুচ্ছেদ-৪৬৮, ২/৯৫ পৃঃ)।
৬৪৩. সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩২-এর আলোচনা দ্রঃ।
৬৪৪. ছহীহ মুসলিম হা/১০০০, ১/১৮১ পৃঃ, (ইফাবা হা/৮৫৪), ‘ছালাত’ অধ্যায়-৫, ‘কাতার
সোজা করা’ অনুচ্ছেদ-২৮; মিশকাত হা/১০৮৮; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১০২০, ৩য় খন্ড, পৃঃ
৫৭, ‘কাতার সোজা করা’ অনুচ্ছেদ।
৬৪৫. ছহীহ বুখারী হা/৭১৯, ১ম খন্ড, পৃঃ ১০০, (ইফাবা হা/৬৮৪, ২/৯৩ পৃঃ), ‘আযান’
অধ্যায়, অনচ্ছেদ-৪৩; মিশকাত হা/১০৮৬; বঙ্গানুবাদ মিশকাত
হা/১০১৮, ৩য় খন্ড, পৃঃ ৫৬।
৬৪৬. ছহীহ আবুদাঊদ হা/৬৬৭, ১ম খন্ড, পৃঃ ৯৭, সনদ ছহীহ ; মিশকাত হা/১০৯৩;
বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১০২৫, ৩য় খন্ড, পৃঃ ৫৮, ‘কাতার সোজা করা’ অনুচ্ছেদ।
পাঠকের সুবিধাথে অল্প কিছু লেখা দিয়েছি। তাতে আপনাদের পড়তে সুবিধা হবে।
চলবে...........
إرسال تعليق